আজ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

তালিকাভুক্তির আগে থেকে বিগত বছরগুলোতে আইসক্রীম বা পণ্য বিক্রি কম দেখিয়ে ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত তাওফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইসক্রিম। যেসব অর্থ বিদেশে পাঁচার করেছে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকরামুল হক। তবে গতবছরে শেয়ার কারসাজিতে নামে তার নেতৃত্বাধীন দল। এর মাধ্যমে শেয়ার দর অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়। যা ধরে রাখার জন্য এখন মুনাফায় ব্যাপক উত্থান দেখানো হচ্ছে। এছাড়া বছরের ব্যবধানে লভ্যাংশ হয়ে গেছে দ্বিগুণ। তবে কোম্পানিটির শেয়ার দর বাড়ার পেছনে কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পায়নি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। তাই কোম্পানিটির দর বৃদ্ধি ও বিগত বছরগুলোর পণ্য বিক্রি নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) তদন্ত করার দাবি বিনিয়োগকারীদের।

এ কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ কারসাজির জন্য লভ্যাংশ দিগুণ করলেও অনেক শেয়ারহোল্ডারদের ব্যাংক হিসাবে ঘোষিত নগদ লভ্যাংশ প্রেরণ করেনি। যা নিয়ে বিএসইসিতে লিখিত অভিযোগও করেছে কয়েক জন ভুক্তভোগী শেয়ারহোল্ডারেরা।

লাভেলো আইসক্রীমের সাবেক এক কর্মকর্তা অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, লাভেলোর যে পরিমাণ আইসক্রীম বিক্রি হয়েছে, তা বিগত বছরগুলোতে দেখায়নি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে। এখন তারাই ৬ মাসের ব্যবসায় আইসক্রীম বিক্রি থেকে আয় ও নিট মুনাফায় ব্যাপক উত্থান দেখাচ্ছে। এর পেছনে প্রধান কারন হিসেবে রয়েছে অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি পাওয়া লাভেলোর শেয়ার দর ধরে রাখা। যেনো বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে শেয়ার বিক্রির চাঁপ তৈরী না করে।

দেখা গেছে, গত বছরের ২৯ জানুয়ারি লাভেলো আইসক্রিমের প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ২৯.৮০ টাকা। সেখান থেকে দফায় দফায় দাম বেড়ে সাড়ে ৫ মাসের ব্যবধানে ১৫ জুলাই ১০৬.৪০ টাকায় উঠে। অর্থাৎ প্রতিটি শেয়ারের দাম বাড়ে ৭৬.৬০ টাকা বা ২৫৭ শতাংশ। তবে মাকসুদ কমিশনের দায়িত্ব গ্রহনের পরে শেয়ারবাজারে বড় পতনে কোম্পানিটির শেয়ার দর কমে ২০ এপ্রিল নেমে এসেছে ৮০.৬০ টাকায়।

গত বছরের ২৯ জানুয়ারির ২৯.৮০ টাকার শেয়ারটি যখন গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ৪৮.৪০ টাকায় উঠে আসে, তখনই অস্বাভাবিক মনে হয় ডিএসইর কাছে। যা বাড়ার পেছনে কোন যৌক্তিক কারণও খুঁজে পায়নি ডিএসই কর্তৃপক্ষ। তাই শেয়ারটিতে বিনিয়োগের বিষয়ে বিনিয়োগকারীদেরকে সতর্ক করে ডিএসই কর্তৃপক্ষ। তবে থামেনি কারসাজিকাররা। এরপরে গত বছরের ১৩ মে লাভেলো নিয়ে আবারও বিনিয়োগকারীদেরকে সতর্ক করে তথ্য প্রকাশ করে ডিএসই কর্তৃপক্ষ।এই অবস্থায় শেয়ারটির দর ধরে রাখার জন্য মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর কৌশল হাতে নিয়েছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। তারা এরইমধ্যে আগের বছরের তুলনায় মুনাফা ও লভ্যাংশে ব্যাপক উত্থান দেখিয়েছে। তাই কোম্পানিটির বিষয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকা উচিত। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত লাভেলো আইসক্রিমের শেয়ারের বিষয়টি তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।

এ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৪) আইসক্রীম বিক্রি দেখিয়েছে ৭৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা। যা থেকে সব ব্যয় শেষে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ১২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। অথচ আগের অর্থবছরের একইসময়ে ৪২ কোটি ৫৬ লাখ টাকার আইসক্রীম বিক্রি ও ৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকার নিট মুনাফা হয়েছিল। এ হিসেবে চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে বিক্রি বেড়েছে ৩১ কোটি ৬০ লাখ টাকার বা ৭৪%। আর নিট মুনাফা বেড়েছে ৮ কোটি ৯ লাখ টাকার বা ১৬৭%।

মুনাফায় এমন অস্বাভাবিক উত্থান হলেও প্রশাসনিক ব্যয় কমেছে। এছাড়া বাজারজাতকরন ও বিক্রিবাবদ ব্যয় (মার্কেটিং অ্যান্ড সেলিং) বাড়েনি। কোম্পানিটির আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধের ৭৯.৪৯ লাখ টাকার প্রশাসনিক ব্যয় চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে হয়েছে ৭৯.১২ লাখ টাকা। আর ৭৪% বিক্রি বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিটিতে বাজারজাতকরন ও বিক্রিবাবদ ব্যয় ৫.৮৭ কোটি থেকে ৫.৯৪ কোটি টাকা হয়েছে। এরমধ্যে কোম্পানিটির বিক্রি বৃদ্ধিতে পণ্য সরবরাহে গাড়িতে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক হলেও তেমনটি হয়নি। ৭৪% বিক্রি বৃদ্ধি পাওয়া এ কোম্পানিটিতে জ্বালানি ও টোলবাবদ আগের অর্থবছরের ৬ মাসের ৯.৩৯ লাখ টাকার ব্যয় এ অর্থবছরের ৬ মাসে হয়েছে ৯.৪৬ লাখ টাকা।

আইসক্রীম উৎপাদনকারী এক কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা  বলেন, আগের অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে কোন কোম্পানির ৭৪% শতাংশ আইসক্রীম বিক্রির ঘটনা জানা নেই। দেশের সেরা ব্র্যান্ডের আইসক্রীমগুলোরও হয়নি। আর ৭৪% বিক্রি বেশি থেকে ১৬৭% মুনাফা বৃদ্ধি পাওয়া অস্বাভাবিক। কারন এরইমধ্যে সবকিছুতেই ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশি। তবে ৭৪% আইসক্রীম বিক্রি সত্ত্বেও বাজারজাতকরন ও বিক্রিবাবদ ব্যয় বৃদ্ধি না পাওয়াটা খুবই সন্দেহজনক। এমনটি হওয়ার কথা না। এরমধ্যে পণ্য বিক্রি বাড়লেতো গাড়ি ব্যবহৃত হয়েছে বেশি, সে হিসেবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়াও স্বাভাবিক।

শেয়ারের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির মধ্যে বড় ফাঁয়দা হাসিল করে নিয়েছে লাভেলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইকরামুল হক। যিনি গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ৩০ লাখ শেয়ার বিক্রি করেছেন। যার গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি বাজার দর ছিল প্রতিটি ৪৭.৯০ টাকা করে ১৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এছাড়া তিনি সম্প্রতি তার ভাই জাহিদুল হককে ২০ লাখ শেয়ার হস্তান্তর করেছেন। যেসব শেয়ার বিক্রি করতে ঘোষণা দিতে হবে না। তবে ইকরামুল হক নিজে বিক্রি করতে গেলে আগেই ঘোষনা দেওয়া লাগতো। যাতে করে শেয়ার দরে পতন হতে পারতো।

ডিএসইর এক পরিচালক বলেন, এখনতো কোম্পানিগুলোর কারসাজি খোলামেলাভাবেই হয়। শেয়ার কারসাজি হয়, এমন প্রায় সব কোম্পানিতেই ওইসব কোম্পানির উদ্যোক্তা/পরিচালক ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জড়িত থাকে। তারা গেম্বলারদের সঙ্গে বসে কারসাজির পরিকল্পনা করে। শেয়ার দর বাড়াতে কখন এবং কয়টি মূল্য সংবেদনশীল তথ্য দিতে হবে, মুনাফা কি পরিমাণ বাড়িয়ে দেখাতে বা কমাতে হবে, মালিকপক্ষের কত টাকা বিনিয়োগ করতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে গেম্বলাররা তাদের দাবি তুলে ধরে। একইভাবে মালিকপক্ষও তাদের শেয়ার দর কত টাকায় তুলতে হবে, তা জানায়।

তিনি বলেন, লাভেলো আইসক্রিমের শেয়ার দাম বাড়ার পিছনে প্রকৃত ঘটনা কী, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত তদন্ত করে বের করা। যদি কোনো কারসাজির ঘটনা ঘটে তবে কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে কোম্পানিটির শেয়ার দর বৃদ্ধির পরে অস্বাভাবিক মুনাফা বৃদ্ধি নিয়েও তদন্ত করা উচিত। তা না হলে বারবার বাজারে কারসাজির ঘটনা ঘটবে।

শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানো ও তা ধরে রাখার জন্য কোম্পানিটির মুনাফা ও লভ্যাংশে উন্নতি হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোম্পানিটির পর্ষদ আগের অর্থবছরের ১০% থেকে বাড়িয়ে ২০% লভ্যাংশ দিয়েছে। আর কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের ৬ মাসের (জুলাই – ডিসেম্বর ২০২৪) ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) বেড়েছে ১৬৭%। এ কোম্পানিটির আগের অর্থবছরের ৬ মাসের ০.৫৭ টাকার ইপিএস চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে দেখানো হয়েছে ১.৫২ টাকা।

 

Exit mobile version