২০২৪ যতোটা না যুদ্ধ-সংঘাতের বছর; তার তুলনায় বেশি নির্বাচনের। বিশ্বের কমপক্ষে ৬০টি দেশে এ বছর হয়েছে নির্বাচন। বেশিরভাগ দেশেই ক্ষমতাসীনদের মেনে নিতে হয়েছে পরাজয়। ইউরোপজুড়ে ডানপন্থিদের হারিয়ে উত্থান হয়েছে বাম ও মধ্যপন্থিদের। নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতাবদলের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে সিরিয়ার মতো ব্যতিক্রমী উদাহরণও। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্যমতে, মূল্যস্ফীতি, গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে হতাশা আর ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই দেখা গেছে চলতি বছরের নির্বাচনগুলোয়।
বছরের অন্যতম আলোচিত নির্বাচন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের হারিয়ে জয়ী হয়েছে রিপাবলিকানরা। শুধু তাই নয়, কংগ্রেসের দুই কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি। পর পর তৃতীয় বারের মতো এবছর ক্ষমতাসীন দলের পরাজয় হলো মার্কিন নির্বাচনে। যদিও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনে অংশ নেননি। তবে তার দলের ঠিকই পরাজয় হয়েছে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, চলতি বছর ক্ষমতাসীন দলগুলোর ভরাডুবির মূল কারণ- অর্থনৈতিক মন্দা। তাছাড়া, গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে হতাশাও ছিল আরেকটি বড় কারণ।
এই বছরের শুরুতেই ‘ডামি’ নির্বাচন করে টানা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদে বসেছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। তবে আগের দুইবারের বিতর্কিত নির্বাচন করে টিকে গেলেও এবার শেষ রক্ষা হয়নি। চতুর্থবার ক্ষমতা নেয়ার মাস ছয়েক পরই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। ফলে তার ১৫ বছরের বেশি সময়ের স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটে।
যুক্তরাজ্যেও ক্ষমতাসীন কনজার্ভেটিভ পার্টির ১৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে জয়ী হয় বামপন্থি লেবার পার্টি। ক্ষমতাসীন দলের সবচেয়ে নাটকীয় পরাজয় বলা যেতে পারে বতসোয়ানার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির পরাজয়কে। প্রায় ৬০ বছর ধরে দেশটির ক্ষমতায় ছিল বতসোয়ানা ডেমোক্র্যাটিক পার্টি।
যেসব দেশে ক্ষমতাসীন দলগুলো টিকে গেছে , তারাও খেয়েছে বড় ধাক্কা। ভারতে চলতি বছর পর পর তিন মেয়াদের মতো ক্ষমতায় এসেছে নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারেনি। জোট সরকার গঠন করতে হয়েছে মোদিকে। জাপানেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশী সময় দেশ শাসন করা লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস বা এএনসি।
তবে, ২০২৪ এর নির্বাচনে ইতিহাস গড়েছে মেক্সিকো। দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন কোনো নারী। প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন ক্ষমতাসীন মরেনা পার্টির প্রার্থী ক্লডিয়া শেইনবাউম।
ইউরোপের নির্বাচনেও লক্ষ্য করা গেছে আদর্শগত পরিবতন। ফ্রান্স, গ্রিস, স্লোভেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বামপন্থিদের বেছে নিয়েছেন দেশগুলোর জনগণ। অবশ্য, চলতি বছর জুনে আগাম ভোটের আয়োজনের পর থেকেই অস্থিরতা চলছে ফ্রান্সে। সম্প্রতি বিশেষ ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রীর বাজেট পাশকে কেন্দ্র করে আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। ওঠে প্রেসিডেন্ট ম্যাকরনের পদত্যাগের দাবিও।
নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা বদলের বাইরেও ২০২৪ জুড়ে বিভিন্ন দেশে ঘটেছে ব্যতিক্রমও। চলতি বছরের মে-তে বিমান দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির আকস্মিক মৃত্যুতে নির্ধারিত সময়ের আগেই হয় নির্বাচন। বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন উদারপন্থি মাসুদ পেজেশকিয়ান।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সিরিয়ায় গেল নভেম্বরের শেষ দিকে হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে বিদ্রোহীরা। তাদের অভিযানের মুখে মাত্র ১১ দিনের মাথায় দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন ২ যুগের শাসক বাশার আল আসাদ।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতেও দেখা দিয়েছে জটিলতা। ডিসেম্বরের শুরুতে আকস্মিক সামরিক আইন জারি করে অভিশংসিত হন প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল। তার বিরুদ্ধে আনা হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগও, আদালতে চলছে যার বিচার। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। সুক ইওলের বদলে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী হান ডাক-সু। মাত্র ২ সপ্তাহের ব্যবধানে অভিশংসিত হন তিনিও। বর্তমানে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন অর্থমন্ত্রী চোই সাং মোক।