৫ আগস্ট। শিক্ষার্থী-জনতার গণঅভ্যুত্থানে কেবল ক্ষমতা না, দেশ ছাড়তে বাধ্য হন সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আগেই শেখ হাসিনার পতনের একদফা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো। এই ঘটনার মাত্র মাসখানেক আগেও সম্ভবত কারও ভাবনায় ছিল না, ক্ষমতা হারাতে পারে পরাক্রমশালী আওয়ামী লীগ।
যদিও গেল ২০১৩-১৪ সাল থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছিল বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। কিন্তু তাতে নড়েনি শেখ হাসিনার ক্ষমতার মসনদ। জুলাই-আগস্টের কোটাবিরোধী আন্দোলনে যে এমন গণবিস্ফোরণ ঘটবে, তা ধারণাই করতে পারেনি ক্ষমতাসীনরা।
অবশ্য পেছনের গল্পটা অনেক ত্যাগ আর তিতীক্ষার। কেবল জুলাই-আগস্টেই প্রাণ দিতে হয়েছে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে। আহত হয়েছেন অসংখ্য।
ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার আর প্রশাসনসহ সবকিছুকে দলীয়করণ করেও জনআকাঙ্ক্ষার বিপরীতে যে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না, ৫৪ বছরের বাংলাদেশে তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষার তুলনায় বড় কোনও শক্তি নেই, সেই শিক্ষা বাংলাদেশকে দিয়ে গেলো ২০২৪। মানুষের চাওয়া-পাওয়া, অধিকারকে গুরুত্ব না দিলে একসময় যে গণবিস্ফোরণ হবেই, তা জানান দিয়েছে এ বছর।
ক্ষমতার দাপট বা উন্নয়নের গল্প আর স্বপ্নের বিপরীতে মানুষের মর্যাদা-সম্মান আর বৈষম্যহীন সমতার দেশ গড়তে আগামীতে রাজনীতিকরা বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকবেন, সেই প্রত্যাশা বিশ্লেষকদের। তবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনীতিকদের যে কোনও বিকল্প নেই, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দেন তারা।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রিয়াজ বলেন, সবচেয়ে বড় বার্তা হচ্ছে, জনগণের শক্তির চেয়ে বড় কোনও শক্তি নেই। রাষ্ট্র তৈরি করেন, নিপীড়ক বাহিনী তৈরি করেন, রাজনীতির খেলা খেলতে পারেন, সংবিধান বদল করতে পারেন, নির্বাচনীব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে পারেন, ব্যক্তির সমস্ত ক্ষমতা পুঞ্জিবিত করতে পারেন এক হাতে, তবে জনগণের শক্তি হচ্ছে সবচেয়ে বড় শক্তি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, চব্বিশের নির্বাচনটা মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে চূড়ান্তভাবে অবজ্ঞা করেছিল। জুলাই-আগস্টে মৃত্যুকে ভয় না পাওয়ার যে সাহস ওই সাহসটাই কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনটা এনে দিয়েছিল।
সেই সাথে টেকসই গণতন্ত্রের জন্য মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা তা বাস্তবায়নে অন্তর্বতী সরকার ও রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষকে যত্নশীল হওয়ার কথাও বলছেন তারা।
ড. আলী রিয়াজ বলেন, এতগুলো মানুষের মৃত্যু, এতগুলো মানুষের আহত হওয়ার আহ্বান— তাদের মধ্য দিয়ে মানুষ কী চাচ্ছে, মানুষ গণতন্ত্র চায়, মানুষ অংশগ্রহণের রাজনীতি চায়, নির্বাচন হইতে হবে। কিন্তু যে নির্বাচন প্রকৃতপক্ষে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে এবং এই সংস্কারগুলো আপিল করতে পারবে সেই পথের দিকে আগানো দরকার।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ভোটাধিকারের সাথে বাড়তি রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনটা চাচ্ছে এবং রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্কের মধ্যে যে অমর্যাদার জায়গাগুলো (ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতির জায়গা) যেন পরিবর্তন হয়।
কেবল নির্বাচনই যে গণতন্ত্র নয়, বরং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও জনবান্ধব নীতির বাস্তবায়ন যে মানুষের মৌলিক প্রত্যাশা, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সেই শিক্ষা মাথায় রেখেই আগামীর রাজনীতি চলবে, বিশ্বাস করতে চান দেশবাসী।