বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ ৩৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা ও অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের এই ৩৭ কর্মকর্তা- কর্মচারী বিভিন্ন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদের মালিকও তারা।
প্রশ্ন উঠেছে, শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলার মাঝেই সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানকে কীভাবে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো। এ নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন চলছে। এছাড়া অন্য দুর্নীতিবাজদের মধ্যে অনেকেই দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন বলেও বেবিচকে (বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ) আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গত ২১ এপ্রিল ও বর্তমান সরকারের সময় গত ২৪ অক্টোবর দুই দফায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলাসহ অনুসন্ধানের বিষয়টি চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়কে নিশ্চিত করেছে দুদক।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এর আগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে বেবিচক কর্মকর্তাদের একটি লম্বা তালিকা দুদকে পাঠানো হয়। ওই তালিকায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আছে কিনা, অভিযোগ থাকলে তা তদন্ত হচ্ছে কিনা এবং তদন্ত কোন পর্যায়ে রয়েছে—তা জানতে চাওয়া হয়। ওই তালিকায় ৩৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামও রয়েছে। বিশেষ করে ওই তালিকার ১২ নম্বরে রয়েছে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও বর্তমানে প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের নাম। এছাড়া ওই চিঠিতে সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় চার্জশিট প্রদান করা হয়েছে বলে জানানো হয়। অর্থাৎ বেবিচকের অন্যতম শীর্ষ এই দুই কর্মকর্তা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদের মালিক বলে তারা দুদকের তালিকাভুক্ত রয়েছেন।
এছাড়াও ওই চিঠিতে বেবিচকের সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) সিভিল ডিভিশনের জহিরুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ই/এম) জাকারিয়া, নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তা মিজানুর রহমানেরও নাম রয়েছে। বিশেষ করে মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে মানবপাচারের গুরুতর অভিযোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকৌশল বিভাগ, হিসাব শাখা, লাইসেন্স নবায়ন শাখা, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল, সম্পত্তি শাখা, পুরোনো মালামাল ক্রয়-বিক্রয় শাখা, কল্যাণ শাখায় অনিয়ম হচ্ছে। পাশাপাশি রাডার মেরামত, কেলিব্রেশন, এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম স্থাপন, বোর্ডিং ব্রিজের স্পেয়ার পার্টস ক্রয়, খান জাহান আলী বিমানবন্দর উন্নয়ন, সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নয়ন, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে সংস্কার, কক্সবাজার বিমানবন্দর, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের রানওয়ে সংস্কার, প্যারালাল ট্যাক্সিওয়ে, রানওয়ে সম্প্রসারণ এবং বিদ্যমান টার্মিনালের সম্প্রসারণ, কক্সবাজার বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, রানওয়ে সম্প্রসারণ এবং উন্নয়ন-সংক্রান্ত মেগা প্রকল্পে অনিয়ম হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। দুদকের তালিকাভুক্ত ৩৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব কাজের বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত।
মন্ত্রণালয়কে দেওয়া দুদকের চিঠিতে তালিকাভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বেবিচক কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা আছে কিনা, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে ও তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের নামে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পদ অর্জন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা-সংক্রান্ত কোনও ধরনের বিভাগীয় অনুমোদন গ্রহণ করা হয়েছে কিনা তাও জানতে চাওয়া হয়। এছাড়া সাত ধরনের প্রকল্পের কাজসহ ৯ ধরনের নথিপত্র তলব করছে দুদক।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। গত ১৫ নভেম্বর দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক নাজমুল হাসান দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে হাবিবুর রহমানকে দুদকে ডেকে নেন এবং তার বক্তব্য শোনেন। এরপরও তাকে কীভাবে প্রধান প্রকৌশলী পদে নিয়োগ দেওয়া হলো তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দুদকে খোঁজ-খবর নিয়ে আইনগত দিক বিবেচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা মনে করি, বেবিচকে আমরা যে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছি, সেটি হাবিবুর রহমানকে দিয়েই সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স। ছাত্র-জনতার বিপ্লবে আমরা যে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি— তার সুফল আনতে আমরা সর্বাত্মকভাবে কাজ করে যাচ্ছি। দুর্নীতি বা দুর্নীতিবাজদের কোনও ঠাঁই বেবিচকে হবে না।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, দুদক তদন্ত করছে—এরকম একজন ব্যক্তিকে কোনোভাবেই পদোন্নতি দিয়ে প্রধান প্রকৌশলী করা সমীচীন হয়নি। যারা তাকে পদোন্নতি দিয়েছে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘পদোন্নতির ফলে তার বিরুদ্ধে চলমান অনুসন্ধান বাধাগ্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতিতে জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।’
জানা গেছে, ইতোমধ্যে দুদক আরও একটি তালিকা করেছে। সেই তালিকায় বলা হয়েছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এয়ার কন্ডিশনার ডাক্ট স্থাপন, এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম আপগ্রেডেশন, বিমানবন্দরে কাউন্টার এবং কনভেয়ার বেল্ট স্থাপন, তার যন্ত্রাংশ সরবরাহ, নতুন বোর্ডিং ব্রিজ স্থাপন, পুরোনো বোর্ডিং ব্রিজে যন্ত্রাংশ সরবরাহ ও স্থাপন, বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থানে এলইডি লাইট কেনা ও ফিটিংস, বাগান আলোকসজ্জা, এইচটি এবং এলটি সুইচগিয়ার স্থাপন কাজের নামে অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে। তা ছাড়া বিমানবন্দরের ফ্লোর মাউন্টেড এবং ওয়াল মাউন্টেড প্যানেল স্থাপন, বিমানবন্দরে বিভিন্ন সাইজের পাওয়ার ক্যাবল সরবরাহ, এয়ারফিল্ড গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম স্থাপন, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, অ্যাপ্রোন লাইট ও লাইট ফিটিংস সরবরাহ, আবাসিক ভবনে ইন্টারনাল ইলেকট্রিফিকেশন কাজ, সিএএবির নতুন সদর দফতরে বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট সরবরাহসহ ইএম-সংক্রান্ত কাজ, টার্মিনাল বিল্ডিংসহ বিমানবন্দরের অন্যান্য ভবনের ডেকোরেশন-সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইএম কাজ, বিভিন্ন স্থানে অ্যাপ্রোন মাস্ট লাইট স্থাপন, সিসিআর বিল্ডিং-সংশ্লিষ্ট সব ইএম কাজ, রানওয়ে লাইটিংয়ের জন্য বিভিন্ন সাইজের ক্যাবল সরবরাহ ও সংস্থাপন কাজেও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। এসব কাজে যারা অনিয়ম করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ শুরু করেছে দুদক।
অপরদিকে দুদকের এমন তৎপরতার কারণে আগের মতো অভিযুক্তরা দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন— এমন গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এর আগে নানা অনিয়ম করে দেশ ছেড়ে গেছেন বেবিচকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল খালেক। তিনি প্রায় ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে পরিবার নিয়ে পালিয়েছেন কানাডায়। আর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহীদুজ্জামানও ১৫০ কোটি টাকা নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে বলে অভিযোগ রয়েছে।