‘সর্বজনীন পেনশন স্কিম’ এখন অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। এক সময় প্রতিদিন যেখানে ৪-৫ হাজার মানুষ অ্যানরলমেন্ট বা নিবন্ধন করতেন, এখন এক বছরের ব্যবধানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪-৫ জনে। এমনকি, কোনও কোনও দিন একজন গ্রাহকও এই স্কিমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন না। যারা প্রতি মাসে কিস্তি দিতেন, আগ্রহ হারিয়ে তারাও কিস্তির টাকা জমা দিচ্ছেন না। আর এদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। চাঁদা না দেওয়ার হার অনেক বলে জানা গেছে।
ইতোমধ্যে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্কিমে যুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য নির্ধারিত ‘প্রত্যয়’ স্কিমটি ব্যাপক সমালোচনা ও আন্দোলনের মুখে গত আগস্ট মাসে সার্কুলার জারি করে প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। ফলে পুরো স্কিম এখন বেসরকারিখাত নির্ভর হয়ে পড়েছে। এর কারণে স্কিমের সফলতাও এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। অনেকে বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে স্কিমটি চালিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ, এই স্কিমটি চালানোর জন্য সরকারকে প্রতি মাসে একটা মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
এদিকে, এই স্কিমের সঙ্গে গ্রাহক যুক্ত হোন বা না হোন, স্কিম পরিচালনার জন্য গঠিত জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকেই বহন করতে হচ্ছে। পেনশন স্কিম কর্তৃপক্ষকে চালাতে মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয় বলে জানা গেছে। কারণ, কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যানের বেতনই সাড়ে ৩ লাখ টাকা। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে সার্বক্ষণিক ড্রাইভারসহ গাড়ি সুবিধা এবং প্রকৃত ব্যয় অনুযায়ী টেলিফোন ও মোবাইল সুবিধা। একইভাবে কর্তৃপক্ষের সদস্যদের বেতন নির্ধারিত রয়েছে ৩ লাখ টাকা। সঙ্গে সার্বক্ষণিক ড্রাইভারসহ গাড়ি সুবিধা এবং প্রকৃত ব্যয় অনুযায়ী টেলিফোন ও মোবাইল সুবিধা। প্রতি মাসে তারা এই অর্থ তুলে নিচ্ছেন।
এরই বাস্তবতায় সোমবার (১৪ অক্টোবর) জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের গভর্নিং কাউন্সিলের অনুষ্ঠিত সভা আহ্বান করা হয়েছে। পদাধিকারবলে এই কাউন্সিলের সভায় সভাপতিত্ব করার কথা রয়েছে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের। সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিকেলে সভাটি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। অর্থ বিভাগের নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক সূত্র জানায়, সভায় পেনশন স্কিমের বর্তমান অবস্থা অর্থ উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরা হবে। তবে, পেনশন কর্তৃপক্ষের পক্ষ সভায় স্কিমের বর্তমান দুরবস্থার কথা উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরা হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। কারণ, গত মাসেও অর্থ উপদেষ্টার কাছে স্কিম বিষয়ে অবহিতকরণ সভায় করা হয়। কিন্তু, সেখানে পেনশন স্কিমের সব তথ্য তুলে ধরা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এই স্কিমের হালনাগাদ তথ্য সম্পর্কে একজন কর্মকর্তা জানান, গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত পেনশন স্কিমে মোট নিবন্ধনধারী সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৭২ হাজার ৩৭১ জন। এখন পর্যন্ত এদের কাছ থেকে চাঁদা হিসেবে পাওয়া গেছে ১৩০ কোটি ৩৭ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। এই অর্থ সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিগত ৫ আগস্টের আগে এই কর্মসূচিতে প্রতিদিন ৪-৫ হাজার মানুষ নিবন্ধন করতেন। বর্তমানে এর পরিমাণ ৪০-৫০ জনে নেমে এসেছে। কোনও কোনও দিন ৫ জনের বেশিও হয় না।
তথ্য মতে, চারটি স্কিমের মধ্যে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসরত ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত সমতায় সবচেয়ে বেশি মানুষ নিবন্ধন করেছেন। এর সংখ্যা দুই লাখ ৮৫ হাজার ৮৮৪ জন। এরপর সুরক্ষা স্কিমের নিবন্ধনের সংখ্যা ৬৩ হাজার ১২৫ জন, প্রগতিতে ২২ হাজার ৩৩২ জন এবং বিদেশিদের জন্য নির্ধারিত প্রবাসে মাত্র ৮৯৪ জন নিবন্ধন করেছেন।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট তৎকালীন সরকার এই স্কিমটি চালু করে। সমতা, সুরক্ষা, প্রগতি ও প্রবাস-এই চারটি স্কিমের মাধ্যমে এর কার্যক্রম শুরু হয়। পরে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নতুন করে যুক্ত করা হয় ‘প্রত্যয় স্কিম’। এই স্কিমে শুধু সব স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীনস্থ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানসমূহের চাকরিতে যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী চলতি ২০২৪ সালে ১ জুলাই তারিখ ও তৎপরবর্তী সময়ে নতুন যোগদান করবেন, তাদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়। কিন্তু, পরবর্তীতে গত আগস্টে পুরো প্রত্যয় স্কিম বাতিল করে দেওয়া হয়।
গত ২ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এতে বলা হয়, এই মর্মে জানানো যাচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়, স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রত্যয় স্কিমসহ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে।