নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষ এমন ভয়াবহ বন্যা আগে দেখেনি। পানিবন্দি কয়েক লাখ মানুষ। ডুবে গেছে একতলা সমান সব কাঁচা-পাকা বাড়ি। বন্যার পানি বৃদ্ধি এত আকস্মিক ছিল যে ঘরের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরানোর সুযোগও পায়নি অধিকাংশ পরিবার। ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোও হয়ে উঠেছে দুরূহ। ভয়ংকর হয়ে ওঠা এ বন্যার কারণ কী? দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে এবারের বন্যার কারণ নিয়ে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিশ্লেষকরা বলছেন, ত্রিপুরায় ভারী বৃষ্টি বন্যার একমাত্র কারণ নয়। ভারত বাঁধ খুলে দেওয়ায় উজান থেকে নেমে আসা পানি বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলকে ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ নদী কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা, অসতর্কতা ও সার্বিক অব্যবস্থাপনাও দায়ী।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মো. এজাজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফেনী, নোয়াখালীর এবারের বন্যায় ত্রিপুরার জলবিদ্যুতের বাঁধ দায়ী। মুহুরির উজানের অববাহিকায় অবস্থিত মহারানি ড্যাম খুলে দেওয়া আরও একটি কারণ। অন্যদিকে ত্রিপুরাও ডুবছে, ফ্ল্যাশ ফ্লাড হয়েছে। উজানের নদীতে বাঁধ দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনপরিপন্থি। গত চার দশকে ভারত সরকার প্রায় প্রতিটি নদীতেই বাঁধ, ব্যারেজ ও ড্যাম বানিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলে হঠাৎ করে একদিনে ভেসে যাওয়া কখনোই স্বাভাবিক নয়। তারা পানি ধরে রেখে পূর্বাভাস না দিয়েই পানি ছেড়ে দিয়েছে। তারা জানতো, গত কয়েকদিনের বৃষ্টিপাতে ত্রিপুরায় বাঁধ উপচে পানি যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে তারা পূর্বাভাসের পাশাপাশি অল্প অল্প করে পানি ছেড়ে দিতে পারতো আগে থেকেই। তারা সেটা করেনি।’
আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ সমস্যার জন্য দায়ী উল্লেখ করে এই নদী বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘দুটি দেশের নদীর পানির ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের যৌথ নদী কমিশন রয়েছে। সেই যৌথ নদী কমিশন কাজ কী আমরা জানি না। ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদী, অধিকাংশের মধ্যে বাঁধ রয়েছে। আজ পর্যন্ত পানির ন্যায্য হিস্যা হয়নি। বর্ষায় ভারী বৃষ্টির ফলে কখন ভারত পানি ছাড়বে, কতটুকু পানি আসবে- এ তথ্য দেওয়ার দায়িত্ব তো তাদের। এবারের বন্যায় ভাটিতে পানি আসার পূর্বাভাস পেলে ক্ষয়ক্ষতি থেকে আমরা বাঁচতে পারতাম।’
আমাদের নতজানু নীতির কারণেই এমন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন এই নদী বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ফেনীর মুহুরি প্রজেক্ট এ মুহূর্তে গলার কাঁটা কি না সে পর্যালোচনাও জরুরি। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। বাঁধের পানি ছাড়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, আমরা উল্লেখ করতে চাই- ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর ক্যাচমেন্ট এলাকায় কয়েকদিন ধরে এই বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাংলাদেশে বন্যা মূলত বাঁধের ভাটির দিকের এই বৃহৎ ক্যাচমেন্টের পানির কারণে ঘটেছে।
টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক ফয়েজ আহমেদ তৈয়ব জাগো নিউজকে বলেন, ‘অতিবৃষ্টির পর বন্ধ বাঁধগুলো হঠাৎ যখন একসঙ্গে খোলা হয়, তখন ভরাট হয়ে পড়া আমাদের অঞ্চলে নদীর পানি ধারণ করতে না পেরে অভাবনীয় ক্ষতির বন্যা ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। বিপরীতে আধুনিক আবহাওয়া স্যাটেলাইটের কল্যাণে ব্যাপক বৃষ্টি হবে জেনেও কয়েকটা দিন আগে থেকেই উজানের বাঁধের পানি রিলিজ বা ড্রেনেজের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অতিবৃষ্টির ফোরকাস্ট সত্ত্বেও সপ্তাহখানেক আগেই বাঁধের গেট খুলে পানি ‘স্লো রিলিজ’ করেনি।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের জলবিদ্যুৎ বা ডাইভারশন বাঁধ, জলাধারগুলোতে কী পরিমাণ পানি আছে? বৃষ্টির পূর্বাভাসে কী পরিমাণ নতুন পানি আসবে, কী পরিমাণ পানি রিলিজ করা লাগবে এটা তো ভারত সরকারের জানার কথা, আর আমাদের জানানোর কথা। ভাটির বাংলাদেশের নদীর পলিপতন ও নাব্য পরিস্থিতিতে কী পরিমাণ পানি প্রতি ঘণ্টায় ড্রেন আউট ও রিলিজ করা যাবে এটা ভারতের বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। এসব হাইড্রোলজিক্যাল মডেল এ যুগে সারা বিশ্বে ব্যবহার করা হয়। ভারত কেন তা ব্যবহার করছে না, এ প্রশ্ন কূটনৈতিকভাবে তোলা উচিত।’
যা বলছে আবহাওয়া অফিস
আবহাওয়া অফিস বলছে, বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে অনেকে আমাদের দায়ী করছে। উজান থেকে আসা পানিতে বন্যা সৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া তো আমাদের কাজ নয়। আমরা আগস্ট মাসের শুরুতে এক মাস মেয়াদি পূর্বাভাসে আগাম বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছিলাম। আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, ‘২০ তারিখের আগেই বলা ছিল টানা তিনদিন চট্টগ্রাম-কুমিল্লা অঞ্চলে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে। বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া আমাদের কাজ নয়। সেটা হলে বাংলাদেশের প্রতিটি বন্যার জন্য সরকারকে আমাদের জবাবদিহি করতে হতো। আমাদের দায়িত্ব শুধু দেশের অভ্যন্তরে বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া।’
আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, ‘ভারতে সীমান্তবর্তী এলাকায় কী পরিমাণ বৃষ্টি হয় সেটা আমাদের বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রকে দেওয়ার কথা। এখন বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বন্যার আগে কী পূর্বাভাস দিয়েছে সেটা প্রশাসন দেখবে। আমাদের যে এই সময়ে ভারী বৃষ্টিপাত হবে সেটা আমরা জানিয়েছি। গত ১৬ আগস্ট থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত ১৬ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এতে পানি জমেছে দেড় থেকে দুই ফুট। এই বন্যায় দেশীয় বৃষ্টির অবদান ৮ থেকে ১০ শতাংশ, বাকিটুকু উজানের পানির।’
অভিযোগ বিষয়ে যা বলছে বন্যা পূর্ভাবাস কেন্দ্র
বন্যার বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ পূর্বাভাস কেন্দ্রের পরিচালক নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জাগো নিউজকে বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলে আমাদের মডেল বেজড স্টেশন থাকলেও দক্ষিণাঞ্চলে নেই। ফলে পূর্বাভাস দিতে সমস্যা হয়। আরেকটি বিষয় হলো বাঁধ খোলার ব্যাপারে আমাদের কাছে তথ্য ছিল না। নদ-নদীর পানি কতটুকু বাড়বে, সেই তথ্য তারা জানিয়েছিল। আমরা ১৭ তারিখ থেকে স্পষ্ট করেছিলাম দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে যা বলছে যৌথ নদী কমিশন
পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ড. মো. আবুল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের তো প্রতিদিন বন্যার পূর্বাভাসে বুলেটিন যায়। হঠাৎ তীব্র বৃষ্টি হওয়ায় এমন বন্যা হয়েছে। ভারত তো পানি সংরক্ষণ করে রাখে। বেশি পানি জমা হলে সেটা উপচে পড়ে। বৃষ্টির কারণেই বন্যাটা হয়েছে।’ ‘ফ্ল্যাশ ফ্লাডে হলে ১০-১২ ঘণ্টায় পানি চলে আসে। পদ্মা-মেঘনার পানি হলে আমরা চার-পাঁচদিন আগে থেকে জানতে পারি। কিন্তু চট্টগ্রাম, ফেনীর পাশাপাশি এ নদীগুলো থেকে ফ্ল্যাশ ফ্লাড হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি ভারত ইচ্ছাকৃত পানি ছাড়ার ব্যাপারে মানুষের কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। তাদের বড় কোনো রিজার্ভার নেই যে পানি ধরে রেখে ছেড়ে দেবে। তাদের ওখানে ভারী বৃষ্টিপাত, আমাদের দেশে ভারী বৃষ্টির কারণে বন্যা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে উজানের পানির তথ্যের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। আমরা বলেছি তথ্য দেওয়ার জন্য। তারা বিবেচনা করেছে। এটা নিয়ে পরবর্তী মিটিংয়ে আমরা কথা বলবো।’